খুন্নিবুড়ি ও গায়েবি টাকার পাতিল
শাহজাহান মোহাম্মদ
ছোট বেলায় অনেক ভূত পেতনির গল্প শুনেছি আমার দাদির কাছে।
বর্তমানে দাদি পৃথিবীতে নেই।
তিনি আজব আজব সব জিন ভূতের গল্প বলে গেছেন।
আমাদের বাড়ির চারপাশে কাঁটা তারের বেড়া। মাঝখানে ঘর। ঘরের
বেড়ার মধ্যে মাটি দিয়ে লেপটে দেয়া। আর উপরে টিন। তিনটি ঘর।
আম বাগান ও অন্যান্য বন কাঠের গাছ। পিছনে বাঁশ বাগান। গভীর
বনজঙ্গল।
আমার জন্মেরও আগের কথা। আমার বাবার বয়স যখন তিন বছর।
তখন আমার দাদা মারা যান। বাবাই ঠিকমত তার বাবার কথা বলতে
পারে না। তাহলে তো আমার দেখার কোনো প্রশ্নই আসে না। দাদিকে
‘বু’ বলে ডাকতাম। ‘বু’কে বললাম, দাদার কি হয়েছিল?
অসুখে মারা গেছেন।
কি অসুখ?
দাদি বলল-এই জাগাটা ভালো না। হালালখুন্নি বুড়ি আছে। ঠিক ভর
দুপুরে বাড়ির পিছনে কাঁচা টাকা শুকাতে দিত, নিজে বসে থেকে। হাতে
একটা ছোট লাঠি থাকতো। তবে তার মুখ কেউ দেখতে পেত না।
সম্পূর্ণ শরীর সাদা কাপড়ে ঢাকা থাকতো। এটা অনেকেই দেখেছে। যা
রাতের অন্ধকারে সীমানার এ মাথা থেকে অন্য মাথায় পিতলের পাতিল
ভরতি টাকা গড়িয়ে গড়িয়ে ঘুরে বেড়াত। অনেক সময় রাতের
অন্ধকারে ঝনঝন করে শব্দ করত। এই কথা শুনে আমার শরীরের
সমস্ত লোম দাঁড়িয়ে যেত।
অন্ধকারে ঝিঁঝিঁ পোকা থেমে থেমে ডাক দিত। তখন কোনো বিদ্যুৎ
বাতি ছিল না গ্রামে। হারিকেন বা কুপি জ্বালাতো। ঘরের বাইরে যেতে
ভয় হতো। হাটে হাটে দাদার পান ব্যবসা ছিল। দাদির কোলে আমার
ছোট চাচা (যার বয়স বছর দেড়েক)। তাদের সুখের সংসার।
খেয়েপরে দিন চলে যায়।
একদিন রাতের ঘটনা। দাদা দাদি খেয়েদেয়ে ছেলেদের নিয়ে শুয়ে
পড়েন। হঠাৎ গভীর রাতে দাদা স্বপ্নে দেখেন। তার ঘরের দরজার
সামনে মাটি ফেটে গেছে। একটি পিতলের পাতিলে শুধু কাঁচা টাকা।
পরে তার ঘুম ভেঙে গেলে উঠে দেখেন সেখানে কোনো কিছু নেই।
কিন্তু সে চিন্তা করতে থাকেন, এই টাকা যদি আমি পাই তাহলে আমার
আর কোনো দুঃখ কষ্ট থাকবে না। অনেক টাকার মালিক হবো। এই
চিন্তা করতে করতে ভোর হয়ে যায়। ফজরের নামাজ আদায় করে তার
কাজে চলে যায়। কিন্তু এই কথা দাদা কাউকে বললেন না। এমনকি
দাদিকেও না।
যাথারীতি পরের দিন রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে করে শুয়ে পড়েন।
আবার গভীর রাতে সেই একই জায়গায় পিতলের পাতিলটি মাটি ভেদ
করে উপরে উঠে আসে। স্বপ্নে গায়েবি শব্দে বলে এই টাকা এখানে আছে
কিন্তু তোর জন্য নয়। তোর জন্য নয়। তোর জন্য নয়। এটা তোর
নাতিপুতির জন্য...নাতিপুতির জন্য...নাতিপুতির জন্য। তুই কখনো এতে
হাত দিবি না...হাত দিবি না...হাত দিবি না। তোকে দেখিয়ে
রাখলাম...তোকে দেখিয়ে রাখলাম... তোকে দেখিয়ে রাখলাম।
এই কথা শোনার পর দাদার ঘুম ভেঙে যায়। উঠে দেখেন, দরজার
কাছে কোনো কিছুই নেই। ভাবলেন, চিন্তা করে দেখি তো এখানে টাকার
পাতিল আছে কি না। পরপর দুদিন স্বপ্নে দেখা সত্যি তো হতে পারে।
এই ভেবে ঘরের দরজা খুলে ছোট খন্তা নিয়ে দরজার যে জায়গায় মাটি
ফেটে গিয়েছিল সেখানে খুঁড়তে থাকেন। এদিকে দাদি ঘুমিয়ে আছে তার
ছেলেদের নিয়ে।
এমনভাবে মাটি খুঁড়তে থাকেন যেন দাদির ঘুম না ভেঙে যায়। এক
কোপ দুই কোপ দিতেই ঠং ঠং করে শব্দ হয়। আর সে মনে মনে
ভাবে, এই স্বপ্ন সত্যি হয়ে গেছে। তাড়াহুড়া করে মাটি সরিয়ে দেখে,
পিতলের পাতিল ভরতি শুধু কাঁচা টাকা। এই দেখে তার চোখ ছানাবড়া
হয়ে যায়। সে কি করে আর না করে। সঙ্গে সঙ্গে তার ঘাড়ের গামছা
মাটিতে বিছিয়ে দুই হাত এক করে কাঁচা টাকা তুলে গামছার মধ্যে
রাখেন। এভাবে দ্বিতীয় বার তুলে তারপর তিন বার নেওয়ার সময়
আর টাকা নিতে পারলো না। পাতিলটি মাটির নিচে চলে যায়। এবং
অদৃশ্য হয়ে যায়।
দাদা তাড়াতাড়ি গর্ত মাটি দিয়ে বন্ধ করেন এবং পানি দিয়ে লেপে
দেন। যেন দাদি বুঝতে না পারেন। টাকাগুলো গামছায় বেধে লুকিয়ে
রাখে। এবং শুয়ে পড়ে। ঘুমের মধ্যে সেই গায়েবি শব্দে বলে- কাজটা
ভালো করলে না। এইটা তোর জন্য নয়। বলেছিলাম না এটা পরবর্তী
প্রজন্মের জন্য অর্থাৎ তোর নাতিপুতির জন্য। কিন্তু তুই তো লোভ
সামলাতে পারলি না। ঠিক আছে। তুই এক কাজ কর টাকাগুলো যেখানে
পেয়েছিস সেখানে রেখে আস। কিন্তু কে শোনে কার কথা। টাকা ফেরত
দিল না।
পরের দিন দাদা তার প্রতিদিনের মতো কর্মে চলে যায়। এবং যথারীতি
রাতে একই কথা- কই টাকাগুলো তো ফেরত দিলি না। এখনো সময়
আছে তুই টাকা ফেরত দিয়ে দে।
এদিকে দাদা টাকা রীতিমতো খরচ করতে থাকেন। কখনো দাদিকে
বলেন না। শুধু রাতে গুণে দেখেন। একদিন দাদি বলেন, কী গুণছো?
বলেন, ও তুই বুঝবি না। আমার হিসাব।
এভাবে দিনের পর দিন চলে যায়। এমন এক সময় দাদা অসুস্থ হয়ে
পড়েন। আর কোনো কাজ করতে পারেন না। একদম বিছানায়। শুধু
তার ঠোঁট দুটো নড়ে। দাদি বলেন, কি এত গুণছো। যা আমাকে বলা
যাবে না?
এদিকে দাদার রক্ত পায়খানা শুরু হয়। কত ডাক্তার কত কবিরাজ,
কিন্তু কেউ সুস্থ করে তুলতে পারেনি। এমনি এক সময় তার জীবন
প্রদীপ নিভে যায়। অনেক ঝাড়ফুক করেও কোনো কাজ হয়নি। তবে
পরে কেউ কেউ বলেছে যে তাকে দুষি ধরেছে। যার কারণে তার মৃত্যু
হয়েছে।
আমার দাদিও শিক্ষিত মানুষ ছিলেন না। তবে টাকা পয়সার হিসাব
ঠিক জানতেন। পরে আরও শুনেছিলাম, এই টাকা আমার দাদির
শাশুড়ির, যা মাটির পাতিলে জমিয়ে মাটির নিচে পুতে রেখেছিল।
পরবর্তীতে এটা নাকি সুর হয়ে বেড়াত।
আমার দাদা শিক্ষিত ছিলেন না। শিক্ষিত হলে হয়তো এমন ঘটনা
ঘটতো না। এই লোভ তার কাল হয়ে দাঁড়ায়। লোভে পাপ পাপে মৃত্যু।
কথাটা আসলে কতটা সত্যি তা আজও জানি না।