“ভূতের রাজা দিল বর, জবরে জবরে তিন বর!” বাল্যকালের আর সবকিছু এখন দেখলে
পুরনো মনে হয়। কিন্তু যত দিন যায়, গুপী-বাঘা ততই জোয়ান হয়!
ছোটবেলায় গুপী-বাঘার যে দৃশ্যটা সবচে’ মন কাড়ত, সেটা মনে হয় ভূতের নাচ। সত্যজিৎ
ভূতের সংজ্ঞাই পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন। তাদের দেখে ভয়ে চোখ-কান বন্ধ করার মত কিছুই
ছিল না। এখনো যখন দেখি, মনে হয় সত্যজিতের অন্যতম অসামান্য কারুকার্য এটা। হয়ত
ছোটবেলায় ভাবতাম এটা কার্টুনছবি!
এখন একে একে বলি সিনেমার নাচা চার শ্রেণীর ভূত কারা।
প্রথম দলটা শ্বেতশুভ্র পোশাকপরিহিত, রাজরাজড়া বা অভিজাত না হয়েই যায় না! তারা নাচছে
মৃদঙ্গমের রাজকীয় তালের সাথে। নাচের ভঙ্গি আর তাদের মুখোশের ইঙ্গিত দেখে মনে হচ্ছে, এর
অনুপ্রেরণা দক্ষিণ ভারতের কথাকলি নৃত্য। এদের মধ্যে দু’একটা মুখাবয়ব দেখে মনে হয় যে
তারা জীবদ্দশায় মুসলিম সুলতান গোছের কিছু একটা ছিল।
দ্বিতীয় গ্রুপ শ্যামলা বা কালো রঙের ভূত, কারো উদোম শরীর। এরা সাধারণ খেটে-খাওয়া
বলেই ঠাউর হয়। এদের কারো পোশাক-তরবারি-ঢাল দেখে মনে হচ্ছে পশ্চিমের রাজস্থানী,
আবার কাউকে দেখে মনে হচ্ছে বাংলার লাঠিয়াল। এরা নাচছে কাঞ্জিরার তালে। রাজপুতদের
তলোয়ার নাচ আর মারাঠাদের মার্শাল আর্টের কিছুটা প্রভাব আছে বলে মনে হয়।
তারপরেরটা চেনা সবচে’ সোজা। এদের পোশাক-আশাক যতটা না বিলাতী, তার থেকে বেশি
সাধারণ ইউরোপীয়। এদের কাঠখোট্টা নড়াচড়ার সাথে জুতসই হয়েছে ভাতের পাত্র ঘটমের উপর
চাঁটের আওয়াজ। এরা হুকাবাহী নেটিভকে চপেটাঘাত করলেও আমার হিসাবে ঔপনিবেশিকতার
প্রদর্শন এখানে গৌণ। এই দলে ব্রিটিশদের সাথে ওলন্দাজ-ফরাসীরাও আছে। অষ্টাদশ-ঊনবিংশ
শতকে তারা নিজেদের মধ্যে দেদারসে যুদ্ধ করেছে।
আর শেষের বিশালবপুর দল হলো মধ্যবিত্ত শ্রেণীর শিক্ষিত গোষ্ঠী। ধর্মীয় বেশভূষা থাকলেও
তারা আবশ্যিকভাবে ধর্মগুরু বা ধর্মপ্রচারক নয়, কিন্তু ধর্ম আর ধর্মের মত বিভিন্ন ইজ়ম
তাদেরকে ব্যাপক টানে। আর একে অন্যের উপর মতামত চাপিয়ে দিতে এদের জুড়ি নেই। তাই
এদের কৌতুকপ্রদ অঙ্গভঙ্গির সাথে মানানসই বাদ্যযন্ত্র মোরসিং, যার আরেক নাম জিউ’স হার্প।